লিউকেমিয়া সম্পর্কে আপনার সহায়ক গাইড

লিউকেমিয়া কী? (Leukemia)
লিউকেমিয়া হল এক ধরনের ক্যান্সার যা সাদা রক্তকণিকা (White Blood Cells – WBCs) বা শ্বেত রক্তকণিকাকে প্রভাবিত করে। লিউকেমিয়া শব্দটি এমন সব ক্যান্সার বোঝাতে ব্যবহৃত হয় যা সাদা রক্তকণিকার উপর আক্রমণ করে। এই ক্যান্সার কীভাবে ছড়ায় তা নির্ভর করে লিউকেমিয়ার ধরন এবং এটি কতটা আগ্রাসী তার উপর।


রক্তকণিকার ধরন

রক্তে প্রধানত তিন ধরনের কোষ থাকে:

  • লাল রক্তকণিকা (RBCs) – শরীরে অক্সিজেন পরিবহণ করে

  • সাদা রক্তকণিকা (WBCs) – রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে

  • প্লেটলেটস – রক্ত জমাট বাঁধাতে সাহায্য করে

সাধারণভাবে, লিউকেমিয়া বলতে WBCs-এর ক্যান্সারকেই বোঝানো হয়


সাদা রক্তকণিকার ভূমিকা

WBCs আপনার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার (immune system) গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এরা আপনার শরীরকে নিচের জিনিসগুলো থেকে রক্ষা করে:

  • ব্যাকটেরিয়া

  • ভাইরাস

  • ছত্রাক (ফাঙ্গাস)

  • অস্বাভাবিক কোষ

  • বাইরের ক্ষতিকর পদার্থ

কিন্তু লিউকেমিয়াতে, এই সাদা রক্তকণিকাগুলো স্বাভাবিকভাবে কাজ করে না। এরা খুব দ্রুত বিভাজিত হয় এবং ধীরে ধীরে রক্তে স্বাভাবিক কোষগুলিকে ঠেলে বের করে দেয়।


এই প্রবন্ধে কী থাকছে?

এই লেখাটিতে লিউকেমিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে, যেমন:

  • এটি কীভাবে তৈরি হয়

  • লক্ষণসমূহ

  • ধরনভেদ

  • চিকিৎসা পদ্ধতি

  • বেঁচে থাকার সম্ভাবনা (survival rates)

    লিউকেমিয়া কীভাবে বিকশিত হয়?
    লিউকেমিয়া আপনার অস্থিমজ্জা (bone marrow) থেকে শুরু হয়। এটি একটি স্পঞ্জের মতো টিস্যু যা হাড়ের ভেতরে থাকে এবং এখানেই আপনার রক্তকণিকা তৈরি হয়।

    রক্তকণিকাগুলো পরিপক্ব হওয়ার আগে বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করে। রক্তকণিকা মূলত হেমাটোপয়েটিক স্টেম সেল (hematopoietic stem cell) থেকে উৎপন্ন হয়। এই স্টেম সেলগুলো পরে দুই ধরনের কোষে পরিণত হয়:

    • মাইলোয়েড কোষ (Myeloid cells) – যেগুলো পরিণত হয় লাল রক্তকণিকা (RBC), প্লেটলেট, এবং নির্দিষ্ট ধরনের সাদা রক্তকণিকাতে (basophils, eosinophils, neutrophils)।

    • লিম্ফয়েড কোষ (Lymphoid cells) – যেগুলো পরিণত হয় লিম্ফোসাইট ও ন্যাচারাল কিলার সেলে।

    স্বাভাবিকভাবে পরিপক্ব হওয়া স্টেম সেলগুলো শরীরের গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে থাকে। যেমন:

    • RBCs শরীরের টিস্যু ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গে অক্সিজেন পরিবহণ করে।

    • WBCs সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে।

    • প্লেটলেটস রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে।

    কিন্তু লিউকেমিয়ার ক্ষেত্রে, অস্থিমজ্জায় একটি বিকাশমান স্টেম সেল নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বিভাজিত হতে শুরু করে।

    এই অস্বাভাবিক কোষগুলোকে বলা হয় লিউকেমিয়া কোষ। তারা অস্থিমজ্জার ভেতরের স্থান দখল করে ফেলে এবং স্বাভাবিক রক্তকণিকার বৃদ্ধি ব্যাহত করে।

    এর ফলে যা ঘটে:

    • পরিণত RBC, WBC, এবং প্লেটলেটের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা থাকে না।

    • কম RBC তৈরি হওয়ায় শরীরে যথেষ্ট অক্সিজেন পৌঁছায় না।

    • কম WBC থাকলে সংক্রমণের বিরুদ্ধে শরীর দুর্বল হয়ে যায়।

    • কম প্লেটলেট থাকলে রক্ত জমাট বাঁধা কঠিন হয়।


    লিউকেমিয়ার শ্রেণিবিভাগ কীভাবে হয়?

    ১. বিকাশের গতি অনুযায়ী:

    • অ্যাকিউট লিউকেমিয়া (Acute Leukemia):
      খুব দ্রুত বেড়ে ওঠে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই লক্ষণ দেখা দেয়। জীবন-হানিকর এবং তাৎক্ষণিক চিকিৎসার প্রয়োজন। এটি শিশুদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।

    • ক্রনিক লিউকেমিয়া (Chronic Leukemia):
      ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে। প্রাথমিকভাবে উপসর্গ তেমন বোঝা যায় না। কোষগুলো ধীরে বিকশিত হয় এবং অনেক সময় স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা বজায় রাখে। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে এটি বেশি দেখা যায়।

    ২. কোষের উৎস অনুযায়ী:

    • মাইলোয়েড লিউকেমিয়া: মাইলোয়েড কোষ থেকে উৎপন্ন হলে একে মাইলোয়েড বা মাইলোজেনাস লিউকেমিয়া বলা হয়।

    • লিম্ফোসাইটিক লিউকেমিয়া: লিম্ফয়েড কোষ থেকে উৎপন্ন হলে একে লিম্ফোসাইটিক লিউকেমিয়া বলা হয়।


    লিউকেমিয়ার প্রধান চারটি ধরন

    1. Acute Myeloid Leukemia (AML)

      • শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক উভয়েই আক্রান্ত হতে পারে

      • প্রতি বছর প্রায় ২০,০০০ নতুন কেস (যুক্তরাষ্ট্রে)

      • ৫ বছর বেঁচে থাকার হার: ৩১.৯%

    2. Acute Lymphocytic Leukemia (ALL)

      • প্রধানত শিশুদের মধ্যে দেখা যায়

      • প্রতি বছর প্রায় ৬,০০০ নতুন কেস

      • ৫ বছর বেঁচে থাকার হার: ৭২%

    3. Chronic Myeloid Leukemia (CML)

      • প্রধানত প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে দেখা যায়

      • প্রতি বছর প্রায় ৯,০০০ কেস

      • ৫ বছর বেঁচে থাকার হার: ৭০%

    4. Chronic Lymphocytic Leukemia (CLL)

      • সাধারণত ৫৫ বছর বা তার বেশি বয়সীদের মধ্যে দেখা যায়

      • প্রতি বছর প্রায় ২১,০০০ কেস

      • ৫ বছর বেঁচে থাকার হার: ৮৮.৫%

      • Hairy Cell Leukemia – CLL-এর একটি বিরল ধরন। মাইক্রোস্কোপে কোষগুলো ঝাঁকড়া দেখায় বলে এ নাম।


    লিউকেমিয়ার কারণ ও ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিরা কারা?

    ঠিক কী কারণে লিউকেমিয়া হয় তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি, তবে কিছু ঝুঁকির কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে:

    • পরিবারে লিউকেমিয়ার ইতিহাস

    • ধূমপান (AML-এর ঝুঁকি বাড়ায়)

    • ডাউন সিনড্রোমসহ কিছু জেনেটিক সমস্যা

    • রক্তের রোগ যেমন: মাইলোডিসপ্লাস্টিক সিনড্রোম (“প্রি-লিউকেমিয়া”)

    • আগের ক্যান্সারের চিকিৎসা (কেমোথেরাপি বা রেডিয়েশন)

    • অতিরিক্ত রেডিয়েশনের সংস্পর্শ

    • বেনজিনের মতো রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শ

      লিউকেমিয়ার উপসর্গ কী কী?
      লিউকেমিয়ার উপসর্গগুলোর মধ্যে থাকতে পারে:

      • অতিরিক্ত ঘাম, বিশেষ করে রাতে (নাইট সুইটস)

      • বিশ্রাম নেয়ার পরেও দূর না হওয়া দুর্বলতা ও ক্লান্তি

      • অনিচ্ছাকৃত ওজন কমে যাওয়া

      • হাড়ে ব্যথা ও কোমলতা

      • ব্যথাহীন, ফুলে যাওয়া লিম্ফ নোড, বিশেষ করে গলা ও বগলে

      • লিভার বা প্লীহা বড় হয়ে যাওয়া

      • ত্বকে লাল দাগ (পিটেকিয়া)

      • সহজে রক্তপাত হওয়া ও ক্ষত হলে সহজে নীল ছাপ পড়া

      • জ্বর বা কাঁপুনি

      • ঘন ঘন সংক্রমণ

      লিউকেমিয়া এমন কিছু অঙ্গেও উপসর্গ তৈরি করতে পারে যেখানে ক্যান্সার কোষ প্রবেশ করেছে বা প্রভাব ফেলেছে। উদাহরণস্বরূপ, যদি ক্যান্সার কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে উপসর্গ হতে পারে:

      • মাথাব্যথা

      • বমিভাব ও বমি

      • বিভ্রান্তি

      • পেশি নিয়ন্ত্রণ হারানো

      • খিঁচুনি

      লিউকেমিয়া শরীরের যেসব অংশে ছড়াতে পারে তা নির্ভর করে লিউকেমিয়ার ধরন ও তার আক্রমণাত্মকতার উপর। এটি নিম্নোক্ত অংশে ছড়াতে পারে:

      • ফুসফুস

      • পরিপাকতন্ত্র

      • হৃদপিণ্ড

      • কিডনি

      • অণ্ডকোষ

      ডাক্তারেরা কীভাবে লিউকেমিয়া নির্ণয় করেন?
      আপনার উপসর্গ বা ঝুঁকিপূর্ণ ইতিহাস থাকলে ডাক্তার লিউকেমিয়ার সন্দেহ করতে পারেন। তখন তারা নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করবেন:

      • সম্পূর্ণ মেডিকেল ইতিহাস ও শারীরিক পরীক্ষা

      • রক্ত পরীক্ষা: সম্পূর্ণ রক্তের গঠনের পরীক্ষা (CBC), ও কোষের অস্বাভাবিক চেহারা যাচাই

      • টিস্যু বায়োপসি: হাড়ের মজ্জা বা লিম্ফ নোড থেকে নমুনা নিয়ে পরীক্ষা

      • ইমেজিং টেস্ট: এক্স-রে, আল্ট্রাসাউন্ড, সিটি স্ক্যান, এমআরআই, পিইটি স্ক্যান

      লিউকেমিয়া নিশ্চিতভাবে নির্ণয়ের জন্য হাড়ের মজ্জার বায়োপসি ও অ্যাস্পিরেশন করা হয়।

      লিউকেমিয়ার স্টেজিং কীভাবে হয়?
      স্টেজ নির্ধারণ করা হয় এই বুঝতে যে ক্যান্সার কতটা ছড়িয়েছে। এটি চিকিৎসার পরিকল্পনায় সাহায্য করে।

      • AML ও ALL: ক্যান্সার কোষের চেহারা ও ধরণ অনুযায়ী স্টেজ হয়

      • CLL: রক্তে সাদা কোষের সংখ্যা অনুযায়ী

      • AML ও CML: অপ্রাপ্তবয়স্ক সাদা কোষের (মায়েলোব্লাস্ট) উপস্থিতি বিবেচনা করে

      লিউকেমিয়ার অগ্রগতি ডাক্তাররা কীভাবে পর্যবেক্ষণ করেন?

      • ফ্লো সাইটোমেট্রি

      • লিভার ফাংশন টেস্ট

      • লাম্বার পাংচার (মেরুদণ্ডের তরল পরীক্ষা)

      • ইমেজিং টেস্ট (X-ray, CT, ইত্যাদি)

      লিউকেমিয়ার চিকিৎসা কী কী?
      চিকিৎসা নির্ভর করে:

      • লিউকেমিয়ার ধরন

      • স্টেজ

      • রোগীর সামগ্রিক স্বাস্থ্য

      • অন্যান্য শারীরিক সমস্যা

      চিকিৎসার ধরন:

      • কেমোথেরাপি

      • রেডিয়েশন থেরাপি

      • স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্ট (হাড়ের মজ্জা প্রতিস্থাপন)

      • ইমিউন থেরাপি

      • টার্গেটেড থেরাপি (যেমন ইমাটিনিব – Gleevec)

      লিউকেমিয়ার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব
      চিকিৎসা যত দ্রুত শুরু হয়, রিকভারি তত ভালো হতে পারে। বয়স, জেনেটিক সমস্যা, পূর্বের রক্তের রোগ ইত্যাদি ভবিষ্যতকে প্রভাবিত করতে পারে।

      বিভিন্ন ধরণের লিউকেমিয়ার সার্ভাইভাল রেট:

      ধরনবয়সসীমা৫ বছর বেঁচে থাকার হার
      AMLসাধারণত প্রাপ্তবয়স্ক৩১.৯%
      ALLশিশুদের মাঝে বেশি৭২%
      CLL৫৫ বছরের বেশি৮৮.৫%
      CML৫৫ বছরের বেশি৭০%
      CMML৬০ বছরের বেশিCMML-1: ২০%, CMML-2: ১০%

      লিউকেমিয়া মৃত্যুহার কমছে:
      ২০১২ থেকে ২০২১ পর্যন্ত প্রতি বছর ০.৭% হারে মৃত্যুহার কমছে। ২০১৪–২০২০ সালের মধ্যে সামগ্রিক ৫ বছর বেঁচে থাকার হার ছিল ৬৭%।

      সচরাচর জিজ্ঞাসা:

      লিউকেমিয়া প্রতিরোধ করা যায় কি?
      ঝুঁকি কমাতে পারেন:

      • ধূমপান না করে

      • ওজন নিয়ন্ত্রণে রেখে

      • বেঞ্জিন বা ফরমালডিহাইডের সংস্পর্শ এড়িয়ে

      লিউকেমিয়া কি আগেভাগে ধরা পড়লে নিরাময়যোগ্য?
      হ্যাঁ, আগেভাগে ধরা পড়লে নিরাময়ের সম্ভাবনা বেশি।

      সবচেয়ে আক্রমণাত্মক লিউকেমিয়া কোনটি?
      Acute Myeloid Leukemia (AML) সবচেয়ে আক্রমণাত্মক।

      চিকিৎসকের কাছে কী প্রশ্ন করা উচিত?

      • আমার লিউকেমিয়ার ধরন কী?

      • এটি কোন পর্যায়ে আছে? ছড়িয়েছে কি?

      • কী উপসর্গ হবে?

      • চিকিৎসার পদ্ধতিগুলো কী কী?

      • পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী হতে পারে?

      • ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে অংশ নেওয়া কি উচিত?

      • আমার দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব কী পড়বে?

      • চিকিৎসার পরে কি আমার ক্যান্সার রেমিশনে যেতে পারে?

      • কোনো সহায়ক গ্রুপ আছে কি?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *