কিভাবে রক্তচাপ চার্ট পড়বেন এবং সংখ্যাগুলির মান কী?

রক্তচাপ (Blood Pressure) মানব শরীরের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যা আমাদের হার্ট এবং রক্তনালী থেকে রক্তের প্রবাহের চাপকে নির্ধারণ করে। এটি স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বহু সমস্যার পূর্বাভাস হতে পারে এবং এই জন্য রক্তচাপ পরিমাপের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি। রক্তচাপ দুইটি সংখ্যা দিয়ে পরিমাপ করা হয়: সিস্টোলিক এবং ডায়াস্টোলিক। এই সংখ্যাগুলি কী এবং কীভাবে রক্তচাপ পড়বেন, সে বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হলো।

রক্তচাপের দুটি সংখ্যা

  1. সিস্টোলিক রক্তচাপ:

    • এটি প্রথম সংখ্যা এবং হৃদপিণ্ডের সংকোচনের সময় (হৃদপিণ্ড যখন রক্ত পাম্প করে) রক্তনালীগুলিতে যে চাপ তৈরি হয় তা নির্দেশ করে। এই চাপ সবচেয়ে বেশি থাকে যখন হৃদপিণ্ড রক্তে পূর্ণ হয়ে সংকুচিত হয় এবং রক্তনালীতে রক্ত পাঠায়।

    • উদাহরণস্বরূপ, যদি রক্তচাপ ১২০/৮০ মিমি Hg হয়, তবে ১২০ হল সিস্টোলিক রক্তচাপ।

  2. ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ:

    • এটি দ্বিতীয় সংখ্যা এবং হৃদপিণ্ডের শিথিল অবস্থায় (যতক্ষণ হৃদপিণ্ড পুনরায় রক্তে পূর্ণ হতে থাকে) রক্তনালীগুলিতে চাপের পরিমাণ নির্দেশ করে। এই সময় রক্তনালীতে চাপের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম থাকে।

    • উদাহরণস্বরূপ, একই রক্তচাপ ১২০/৮০ মিমি Hg হলে, ৮০ হল ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ।

রক্তচাপের শ্রেণিবিভাগ

রক্তচাপের মাত্রার ভিত্তিতে স্বাস্থ্যের বিভিন্ন স্তরের শ্রেণিবিভাগ করা হয়। এগুলি হলো:

১. স্বাভাবিক রক্তচাপ

  • সিস্টোলিক: ৯০-১২০ মিমি Hg

  • ডায়াস্টোলিক: ৬০-৮০ মিমি Hg

  • এই রক্তচাপ একটি সাধারণ, সুস্থ রক্তচাপ হিসাবে বিবেচিত হয়। এমন রক্তচাপ থাকার মানে হল যে হৃদপিণ্ড এবং রক্তনালীগুলি স্বাভাবিকভাবে কাজ করছে এবং কোনও অতিরিক্ত চাপ নেই।

২. উচ্চ স্বাভাবিক রক্তচাপ

  • সিস্টোলিক: ১২০-১২৯ মিমি Hg

  • ডায়াস্টোলিক: ৮০-৮৪ মিমি Hg

  • এটি একটি পর্যবেক্ষণীয় অবস্থা। যদিও এটি উচ্চ রক্তচাপের পূর্ণ স্তর নয়, তবে এই ধরণের রক্তচাপ থাকা মানে হচ্ছে যে আপনার রক্তচাপ কমে যেতে পারে যদি আপনি সঠিক জীবনধারা না অবলম্বন করেন।

৩. উচ্চ রক্তচাপ (স্টেজ ১)

  • সিস্টোলিক: ১৩০-১৩৯ মিমি Hg

  • ডায়াস্টোলিক: ৮০-৮৯ মিমি Hg

  • এই পর্যায়ে উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ দেখা যায়। চিকিৎসকরা সাধারণত জীবনযাত্রায় পরিবর্তন (যেমন ডায়েট, ব্যায়াম, প্ররোচনা কমানো ইত্যাদি) এবং যদি প্রয়োজন হয়, মেডিকেশন দেওয়ার পরামর্শ দেন।

৪. উচ্চ রক্তচাপ (স্টেজ ২)

  • সিস্টোলিক: ১৪০ বা তার বেশি মিমি Hg

  • ডায়াস্টোলিক: ৯০ বা তার বেশি মিমি Hg

  • এই স্তরে রক্তচাপ অত্যন্ত বিপজ্জনক হতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদী উচ্চ রক্তচাপের কারণে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, কিডনি ডিজিজ এবং অন্যান্য সমস্যা হতে পারে। এই অবস্থায় চিকিৎসকের পরামর্শ অত্যন্ত জরুরি।

৫. হাইপারটেনসিভ ক্রাইসিস

  • সিস্টোলিক: ১৮০ বা তার বেশি মিমি Hg

  • ডায়াস্টোলিক: ১২০ বা তার বেশি মিমি Hg

  • এই স্তরে, রক্তচাপ অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে ওঠে এবং এটি জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন। এমন পরিস্থিতিতে, একজন রোগীকে অবিলম্বে হাসপাতালে যেতে হবে কারণ এটি স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাকের কারণ হতে পারে।

রক্তচাপ মাপার সঠিক পদ্ধতি

রক্তচাপ সঠিকভাবে মাপতে হলে কিছু বিষয় খেয়াল রাখা প্রয়োজন:

  1. উপযুক্ত যন্ত্র ব্যবহার:

    • রক্তচাপ মাপার জন্য একটি ভাল মানের স্ফিগমোম্যানোমিটার (Blood Pressure Monitor) ব্যবহার করা উচিত। অনেক সময় ডোমেস্টিক ব্যবহারের জন্য ডিজিটাল মাপার যন্ত্রও পাওয়া যায়, যা ব্যবহার সহজ হলেও সঠিক মাপ পাওয়া যাবে কিনা তা নিশ্চিত হতে হবে।

  2. শান্ত অবস্থায় মাপুন:

    • রক্তচাপ মাপার সময় রোগীকে পুরোপুরি বিশ্রাম অবস্থায় থাকতে হবে এবং মাপার আগের ৫ মিনিটের মধ্যে কোনো শারীরিক পরিশ্রম বা স্ট্রেস থেকে বিরত থাকতে হবে।

  3. নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিমাপ করুন:

    • রক্তচাপ মাপার সেরা সময় হলো সকালে বা রাতে, খাওয়ার পর অন্তত ৩০ মিনিট পর। কোনো কফি বা চা পান করার আগে মাপা উচিত।

  4. দ্বিতীয়বার পরিমাপ:

    • প্রথম মাপের পর ১-২ মিনিট বিরতি দিয়ে দ্বিতীয়বার রক্তচাপ মাপুন। এইভাবে রক্তচাপের সঠিক মাত্রা পাওয়া যাবে।

রক্তচাপের সমস্যা এবং উপসর্গ

উচ্চ রক্তচাপ (Hypertension) সাধারণত কোনো নির্দিষ্ট উপসর্গ প্রকাশ করে না, কিন্তু এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব হৃদপিণ্ড, কিডনি এবং মস্তিষ্কে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। কিছু সাধারণ উপসর্গ হতে পারে:

  • মাথাব্যথা

  • বুকের ব্যথা

  • শ্বাসকষ্ট

  • ঘুমের সমস্যা

নিম্ন রক্তচাপ (Hypotension) এর উপসর্গগুলোও থাকতে পারে:

  • মাথা ঘোরা বা অন্ধকার দেখা

  • ক্লান্তি

  • দুর্বল অনুভূতি

চিকিৎসা এবং প্রতিকার

রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে:

  1. সঠিক খাদ্যাভ্যাস:

    • কম লবণযুক্ত খাবার খাওয়া, বেশি ফলমূল, শাকসবজি এবং সঠিক পরিমাণে প্রোটিন গ্রহণ করা।

  2. ব্যায়াম:

    • নিয়মিত ব্যায়াম যেমন হাঁটা, সাঁতার কাটা বা সাইকেল চালানো রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে।

  3. মানসিক চাপ কমানো:

    • যোগব্যায়াম, প্রানায়াম, ধ্যান এবং নিঃশ্বাসের ব্যায়াম মনকে শান্ত রাখতে সহায়ক।

  4. ওজন কমানো:

    • অতিরিক্ত ওজন রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়। সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা প্রয়োজন।

  5. মেডিকেশন:

    • কিছু ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের জন্য ডাক্তার ওষুধও নির্ধারণ করতে পারেন।

উপসংহার

রক্তচাপের মাত্রা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তা সঠিকভাবে মাপা এবং নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। একজন ব্যক্তি যদি নিয়মিত রক্তচাপ মাপেন এবং উপরের পরামর্শগুলো অনুসরণ করেন, তবে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক হবে। তবে, যদি রক্তচাপ কোনও সমস্যা সৃষ্টি করে, তৎকালীন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *