কণ্ঠনালীর ক্যান্সার

কণ্ঠনালীর ক্যান্সার কী?

কণ্ঠনালীর ক্যান্সার হল এক ধরনের গলাবিশেষ ক্যান্সার যা আপনার কণ্ঠনালীকে (larynx) আক্রান্ত করে। কণ্ঠনালী বা ল্যারিংক্স হলো আপনার কণ্ঠস্বরের বক্স। এতে থাকে তরুণাস্থি (cartilage) এবং পেশি (muscles), যা আপনাকে কথা বলার সুযোগ করে দেয়।

এই ধরনের ক্যান্সার আপনার কণ্ঠস্বর নষ্ট করতে পারে। দ্রুত চিকিৎসা না করলে এটি শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউট অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে সব ক্যান্সারের মধ্যে মাথা ও গলার ক্যান্সার ৪ শতাংশ অংশ জুড়ে রয়েছে।

এই ক্যান্সারে বেঁচে থাকার হার নির্ভর করে ক্যান্সারটি কণ্ঠনালীর কোন স্থানে হয়েছে এবং কত দ্রুত তা শনাক্ত করা হয়েছে তার উপর।

আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটির মতে, গ্লটিস (glottis) অংশে স্টেজ ১ পর্যায়ের ক্যান্সারে আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ পাঁচ বছর বা তার বেশি সময় বেঁচে থাকেন। গ্লটিস হলো কণ্ঠনালীর সেই অংশ যেখানে আপনার কণ্ঠস্বরের তার (vocal cords) থাকে।

অন্যদিকে, গ্লটিসের উপরের অংশ অর্থাৎ সুপ্রাগ্লটিসে (supraglottis) স্টেজ ১ ক্যান্সারে আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ৫৯ শতাংশ মানুষ পাঁচ বছর বা তার বেশি সময় বেঁচে থাকেন। সুপ্রাগ্লটিস অংশে থাকে এপিগ্লটিস (epiglottis), যা আপনি গিলতে গেলে কণ্ঠনালী ঢেকে দেয়। এটি খাবারকে ফুসফুসে প্রবেশ করতে বাধা দেয়।

কণ্ঠনালীর ক্যান্সারের লক্ষণ কী কী?

অন্যান্য অনেক ধরনের ক্যান্সারের তুলনায়, কণ্ঠনালীর ক্যান্সারের লক্ষণগুলো তুলনামূলকভাবে সহজেই শনাক্ত করা যায়। এর সাধারণ কিছু লক্ষণ হলো:

  • কণ্ঠস্বর ভেঙে যাওয়া বা কর্কশ হয়ে যাওয়া

  • শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া

  • অতিরিক্ত কাশি

  • রক্তসহ কাশি হওয়া

  • গলা বা ঘাড়ে ব্যথা

  • গলায় জ্বালা বা ব্যথা

  • কানে ব্যথা

  • খাবার গিলতে সমস্যা হওয়া

  • ঘাড় ফুলে যাওয়া

  • ঘাড়ে গাঁট বা ফোলাভাব

  • হঠাৎ করে ওজন কমে যাওয়া

এই লক্ষণগুলো সবসময় ক্যান্সারের কারণে হয় না। তবে যদি এই লক্ষণগুলোর যেকোনোটি এক সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হয়, তাহলে অবশ্যই একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। ক্যান্সার চিকিৎসায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্তকরণ


কণ্ঠনালীর ক্যান্সার কীভাবে হয়?

গলার ক্যান্সার সাধারণত তখনই হয় যখন স্বাস্থ্যবান কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে শুরু করে। এই কোষগুলো টিউমারে রূপ নিতে পারে। কণ্ঠনালীর ক্যান্সার মূলত কণ্ঠস্বরের বক্সে উৎপত্তি হওয়া টিউমার।

এই কোষগুলোর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো ধূমপান। এছাড়াও আরও কিছু কারণ রয়েছে:

  • অতিরিক্ত অ্যালকোহল পান

  • অপুষ্টি বা সঠিক পুষ্টির অভাব

  • হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (HPV) সংক্রমণ

  • দুর্বল প্রতিরোধ ক্ষমতা

  • অ্যাসবেস্টসের মতো বিষাক্ত পদার্থের সংস্পর্শে আসা

  • কিছু জেনেটিক রোগ যেমন ফ্যানকোনি অ্যানিমিয়া (Fanconi anemia)


কাদের কণ্ঠনালীর ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি?

কিছু জীবনধারাগত বিষয় কণ্ঠনালীর ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। এর মধ্যে রয়েছে:

  • ধূমপান করা

  • তামাক চিবানো

  • ফল ও সবজি কম খাওয়া

  • অতিরিক্ত প্রক্রিয়াজাত খাবার খাওয়া

  • অ্যালকোহল পান

  • অ্যাসবেস্টসের সংস্পর্শে থাকা

  • পরিবারের কারও গলার ক্যান্সারের ইতিহাস থাকলে

সতর্কতা: উপরের যেকোনো ঝুঁকি যদি আপনার জীবনে থাকে, তাহলে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং সতর্ক জীবনধারা অনুসরণ করা জরুরি।

কণ্ঠনালীর ক্যান্সার কীভাবে শনাক্ত করা হয়?

কণ্ঠনালীর ক্যান্সার শনাক্তকরণ শুরু হয় আপনার চিকিৎসা ইতিহাস যাচাইয়ের মাধ্যমে। যদি আপনার ক্যান্সারের উপসর্গ থাকে, তবে চিকিৎসক আপনাকে বিস্তারিতভাবে পরীক্ষা করবেন এবং কিছু নির্দিষ্ট পরীক্ষা শুরু করবেন।

প্রথমত, সাধারণত একটি লারিঙ্গোস্কপি (laryngoscopy) করা হয়। এই পরীক্ষায় চিকিৎসক একটি ছোট ক্যামেরাযুক্ত যন্ত্র বা আয়না ব্যবহার করে আপনার কণ্ঠনালী দেখেন।

যদি চিকিৎসক কোনো অস্বাভাবিকতা দেখতে পান, তাহলে তিনি একটি বায়োপসি (biopsy) করতে পারেন। এতে একটি ছোট টিস্যুর নমুনা নিয়ে পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়, ক্যান্সার আছে কিনা তা নির্ধারণের জন্য।

ইমেজিং টেস্ট (যেমন CT স্ক্যান বা MRI স্ক্যান) সাধারণত কণ্ঠনালীর ক্যান্সার শনাক্তে প্রাথমিক পদ্ধতি নয়, তবে এটি সাহায্য করে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছে কিনা তা বুঝতে।


স্টেজ নির্ধারণ (Staging)

যদি ক্যান্সার ধরা পড়ে, পরবর্তী ধাপ হলো স্টেজ নির্ধারণ, অর্থাৎ ক্যান্সার কতদূর ছড়িয়েছে তা বোঝা। সাধারণত TNM সিস্টেম ব্যবহার করে এটি করা হয়:

  • T (Tumor): মূল টিউমারের আকার এবং এটি আশপাশের টিস্যুতে ছড়িয়েছে কিনা।

  • N (Nodes): ক্যান্সার কতদূর পর্যন্ত লিম্ফ নোডে ছড়িয়েছে।

  • M (Metastasis): ক্যান্সার শরীরের অন্য অঙ্গ বা দূরবর্তী লিম্ফ নোডে ছড়িয়েছে কিনা।

আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটির মতে, কণ্ঠনালীর ক্যান্সার সাধারণত প্রথমে ফুসফুসে ছড়িয়ে পড়ে।

ছোট টিউমার যেগুলো ছড়ায়নি, সেগুলো তুলনামূলকভাবে কম ঝুঁকিপূর্ণ। তবে যত বড় টিউমার হয় এবং যত বেশি ছড়ায়, ততই ঝুঁকি বাড়ে এবং বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কমে যায়।


চিকিৎসার বিকল্প কী কী?

চিকিৎসার ধরন নির্ভর করে ক্যান্সারের স্তরের ওপর। প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসক সার্জারি বা রেডিয়েশন থেরাপি ব্যবহার করতে পারেন।

সার্জারি:

প্রথম পর্যায়ে টিউমার অপসারণের জন্য এটি একটি সাধারণ পদ্ধতি। তবে যদি ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে সার্জারির ঝুঁকি বাড়ে। এতে দেখা দিতে পারে:

  • শ্বাস নিতে অসুবিধা

  • খাবার গিলতে সমস্যা

  • ঘাড়ের আকার বিকৃতি

  • কণ্ঠস্বর পরিবর্তন বা হারিয়ে যাওয়া

  • ঘাড়ে স্থায়ী দাগ

রেডিয়েশন থেরাপি:

সার্জারির পরে অবশিষ্ট ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করতে ব্যবহার করা হয়। ছোট টিউমারে এটি এককভাবে ব্যবহৃত হতে পারে।

কেমোথেরাপি:

এটি আরও একটি ক্যান্সার চিকিৎসা পদ্ধতি যা ব্যবহৃত হয়:

  • সার্জারি ও রেডিয়েশনের পরে বাকি ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করতে

  • সার্জারি উপযুক্ত না হলে রেডিয়েশনের সঙ্গে মিলিয়ে

  • যেসব ক্যান্সার পুরোপুরি অপসারণ সম্ভব নয়, সেগুলোর উপসর্গ কমাতে

কখনো কখনো চিকিৎসক সার্জারি বাদ দিয়ে অন্য পদ্ধতিতে শুরু করতে পারেন, যেমন ছোট টিউমার হলে বা খুব দেরিতে ধরা পড়লে।

উদ্দেশ্য: যতটা সম্ভব আপনার জীবনের গুণগত মান (quality of life) ধরে রাখা।

উন্নত পর্যায়ের ক্যান্সার:

সার্জারি, রেডিয়েশন এবং কেমোথেরাপি একত্রে প্রয়োগ করতে হতে পারে।


কণ্ঠস্বর নষ্ট হলে করণীয়

সার্জারির ফলে আপনি আংশিক বা সম্পূর্ণ কণ্ঠনালী হারাতে পারেন। তবে এর মানে এই নয় যে আপনি কথা বলতে পারবেন না। স্পিচ থেরাপি আপনাকে নতুনভাবে কথা বলা শিখাতে পারে।

যদি পুরো কণ্ঠনালী কেটে ফেলা হয়, তাহলে বিকল্প পদ্ধতিতে কথা বলার সুযোগ থাকে:

  • ইসোফেজিয়াল স্পিচ (Esophageal Speech): থেরাপিস্ট শেখায় কীভাবে মুখ দিয়ে বাতাস গিলে ফেরত পাঠিয়ে কথা বলা যায়।

  • ট্র্যাকিও-ইসোফেজিয়াল পাংচার (Tracheoesophageal Puncture): ডাক্তার গলায় একটি স্টোমা (ছিদ্র) তৈরি করে, যেখানে একটি ভাল্ব বসানো হয়। আঙুল দিয়ে ভাল্ব চাপলে কথা বলা যায়।

  • ইলেক্ট্রোল্যারিংক্স (Electrolarynx): এটি একটি বৈদ্যুতিক যন্ত্র যা যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর তৈরি করে।


বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি (Alternative Remedies)

চিকিৎসার পাশাপাশি কিছু বিকল্প পদ্ধতি উপকারে আসতে পারে, যেমন:

  • ধ্যান (Meditation)

  • যোগব্যায়াম (Yoga)

  • আকুপাংচার

  • ম্যাসাজ থেরাপি


কণ্ঠনালীর ক্যান্সার প্রতিরোধে করণীয়

আপনি কিছু জীবনধারা পরিবর্তনের মাধ্যমে কণ্ঠনালীর ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে পারেন:

  • ধূমপান বন্ধ বা কমানো

  • অ্যালকোহল পরিমিত পরিমাণে গ্রহণ

  • কর্মস্থলে অ্যাসবেস্টস বা বিষাক্ত পদার্থ থাকলে সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহার

  • অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ


ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা (The Outlook)

প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা শুরু করাই ক্যান্সার নিরাময়ে মূল চাবিকাঠি।
যত আগে ক্যান্সার শনাক্ত ও চিকিৎসা শুরু হয়, বেঁচে থাকার সম্ভাবনাও তত বেশি।
বিশেষ করে, ক্যান্সার যদি লিম্ফ নোড বা শরীরের অন্য অংশে না ছড়ায়, তাহলে চিকিৎসার সাফল্যের হার অনেক বেশি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *