মুখগহ্বরের ক্যানসার

মুখগহ্বরের ক্যানসার হলো এমন এক ধরনের ক্যানসার, যা মুখ বা গলার টিস্যুতে তৈরি হয়। এটি “হেড অ্যান্ড নেক ক্যানসারস” নামে পরিচিত একটি বড় ধরনের ক্যানসারের দলের অন্তর্ভুক্ত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই ক্যানসার মুখ, জিহ্বা ও ঠোঁটে থাকা স্কোয়ামাস সেলে (squamous cells) গঠিত হয়।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর ৫৩,০০০-এর বেশি নতুন মুখগহ্বরের ক্যানসার শনাক্ত হয়, এবং এটি সাধারণত ৪০ বছর বা তার বেশি বয়সীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। মুখের ক্যানসার প্রায়শই তখনই শনাক্ত হয়, যখন এটি গলার লিম্ফ নোডে ছড়িয়ে পড়ে। এই কারণে প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্তকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মুখগহ্বরের ক্যানসার থেকে বেঁচে থাকার জন্য।

এই ক্যানসারের ঝুঁকি কীভাবে বাড়ে, এর বিভিন্ন স্তর কী কী — এসব সম্পর্কে জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

মুখগহ্বরের ক্যানসারের ধরনসমূহ
মুখগহ্বরের ক্যানসার অন্তর্ভুক্ত করে নিম্নলিখিত অংশগুলোর ক্যানসার:

  • ঠোঁট

  • জিহ্বা

  • গালের ভিতরের অংশ

  • মাড়ি

  • মুখের নিচের অংশ (ফ্লোর অফ দ্য মাউথ)

  • মুখের উপরিভাগ ও পেছনের নরম অংশ (হার্ড ও সফট প্যালেট)

আপনার দাঁতের চিকিৎসক (ডেন্টিস্ট) প্রায়ই মুখের ক্যানসারের প্রাথমিক লক্ষণগুলো প্রথমে শনাক্ত করে থাকেন। প্রতি ছয় মাস অন্তর দাঁতের চেকআপ করালে আপনার মুখের স্বাস্থ্যের অবস্থা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়।


মুখগহ্বরের ক্যানসারের ঝুঁকির কারণসমূহ
মুখের ক্যানসার হওয়ার অন্যতম বড় ঝুঁকির কারণ হলো তামাকের ব্যবহার। এতে সিগারেট, সিগার, পাইপ ধোঁয়া এবং চিবানো তামাক—সবই অন্তর্ভুক্ত।

যাঁরা অতিরিক্ত পরিমাণে অ্যালকোহল ও তামাক একসঙ্গে ব্যবহার করেন, তাঁদের ঝুঁকি আরও অনেক বেশি, বিশেষ করে যখন নিয়মিতভাবে এই অভ্যাসগুলো বজায় থাকে।

অন্যান্য ঝুঁকির কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে:

  • হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (HPV) সংক্রমণ

  • মুখে দীর্ঘ সময় ধরে সূর্যের আলো পড়া

  • পূর্বে মুখের ক্যানসার হয়েছে এমন ইতিহাস

  • পরিবারে মুখ বা অন্য কোনো ধরনের ক্যানসারের ইতিহাস

  • দুর্বল রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা

  • অপুষ্টি বা দুর্বল পুষ্টিগত অবস্থা

  • জিনগত সমস্যা বা সিনড্রোম

  • পুরুষ হওয়া

পুরুষদের ক্ষেত্রে এই ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নারীদের তুলনায় দ্বিগুণ

মুখগহ্বরের ক্যানসারের উপসর্গসমূহ
মুখের ক্যানসারের সাধারণ লক্ষণগুলো হলো:

  • ঠোঁট বা মুখে কোনো ক্ষত যা সেরে উঠছে না

  • মুখের যেকোনো স্থানে গুটির মতো অংশ বা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি

  • মুখ থেকে রক্তপাত হওয়া

  • দাঁত নড়ে যাওয়া বা ঢিলা হয়ে পড়া

  • গিলতে কষ্ট হওয়া বা ব্যথা অনুভব করা

  • ডেন্টার (নকল দাঁত) পরতে সমস্যা হওয়া

  • গলায় গাঁঠ বা ফোলাভাব

  • একটানা কানে ব্যথা (যা সহজে সারে না)

  • হঠাৎ ও দ্রুত ওজন কমে যাওয়া

  • নিচের ঠোঁট, মুখ, গলা বা থুতনিতে অবশভাব বা অনুভূতি কমে যাওয়া

  • মুখ বা ঠোঁটে সাদা, লাল-সাদা বা সম্পূর্ণ লাল দাগ বা ছোপ

  • গলা ব্যথা

  • চোয়ালে ব্যথা বা শক্ত হয়ে যাওয়া

  • জিহ্বায় ব্যথা


গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ:
এই উপসর্গগুলোর মধ্যে কিছু, যেমন গলা ব্যথা বা কানের ব্যথা, অন্য সাধারণ সমস্যার কারণেও হতে পারে। তবে, যদি এই উপসর্গগুলোর যেকোনো একটি আপনার মধ্যে দেখা দেয় এবং দীর্ঘদিন থাকে বা একাধিক উপসর্গ একসঙ্গে দেখা যায়, তাহলে অবিলম্বে একজন ডেন্টিস্ট বা চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি

মুখগহ্বরের ক্যানসার কীভাবে নির্ণয় করা হয়?

প্রথমে, আপনার চিকিৎসক বা ডেন্টিস্ট একটি শারীরিক পরীক্ষা করবেন। এতে মুখের ছাদ ও নিচের অংশ, গলার পেছন দিক, জিহ্বা, গাল এবং গলার লিম্ফ নোডগুলো ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। যদি চিকিৎসক উপসর্গের সঠিক কারণ নির্ণয় করতে না পারেন, তাহলে আপনাকে একজন **ইএনটি (কান-নাক-গলা বিশেষজ্ঞ)**র কাছে পাঠানো হতে পারে।

যদি কোনো টিউমার, বৃদ্ধি বা সন্দেহজনক ঘা পাওয়া যায়, তাহলে চিকিৎসক ব্রাশ বায়োপসি বা টিস্যু বায়োপসি করবেন।

  • ব্রাশ বায়োপসি একটি ব্যথাহীন পদ্ধতি, যেখানে ঘা থেকে কোষ সংগ্রহ করে স্লাইডে নেওয়া হয়।

  • টিস্যু বায়োপসিতে টিউমারের একটি অংশ কেটে নিয়ে মাইক্রোস্কোপে ক্যানসার কোষ আছে কিনা পরীক্ষা করা হয়।

চিকিৎসক প্রয়োজনে নিচের পরীক্ষাগুলোর যেকোনো একটি বা একাধিক করতে পারেন:

  • এক্স-রে: চোয়াল, বুক, বা ফুসফুসে ক্যানসার ছড়িয়েছে কিনা তা দেখতে

  • সিটি (CT) স্ক্যান: মুখ, গলা, গলা, ফুসফুস ইত্যাদিতে টিউমার শনাক্ত করতে

  • পিইটি (PET) স্ক্যান: ক্যানসার লিম্ফ নোড বা শরীরের অন্য অংশে ছড়িয়েছে কিনা

  • এমআরআই (MRI) স্ক্যান: মাথা ও গলার আরও স্পষ্ট ছবি ও ক্যানসারের স্তর নির্ধারণ করতে

  • এন্ডোস্কপি: নাক, সাইনাস, গলা, শ্বাসনালি ও ট্রাকিয়া পরীক্ষা করতে


মুখগহ্বরের ক্যানসারের স্তর (Stages)

মুখগহ্বরের ক্যানসারের চারটি পর্যায় আছে:

  • স্টেজ ১: টিউমার ২ সেমি বা এর চেয়ে ছোট, এবং লিম্ফ নোডে ছড়ায়নি

  • স্টেজ ২: টিউমার ২–৪ সেমি, এখনো লিম্ফ নোডে ছড়ায়নি

  • স্টেজ ৩: টিউমার ৪ সেমির বেশি, অথবা যেকোনো আকারের টিউমার একটিমাত্র লিম্ফ নোডে ছড়িয়েছে

  • স্টেজ ৪: টিউমার যেকোনো আকারের হতে পারে এবং এটি কাছাকাছি টিস্যু, লিম্ফ নোড বা শরীরের অন্য অংশে ছড়িয়ে পড়েছে

Survival Rate (বাঁচার হার):
ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউট অনুযায়ী, ৫ বছরের বাঁচার হার:

  • ৮৩% – যদি ক্যানসার ছড়ায়নি (লোকালাইজড)

  • ৬৪% – যদি ক্যানসার কাছাকাছি লিম্ফ নোডে ছড়িয়েছে

  • ৩৮% – যদি ক্যানসার শরীরের অন্য অংশে ছড়িয়েছে
    মোটামুটি ৬০% রোগীই ৫ বছর বা তার বেশি সময় বেঁচে থাকেন। প্রাথমিক ধাপে নির্ণয় হলে ৭০–৯০% পর্যন্ত বাঁচার হার থাকে।


মুখগহ্বরের ক্যানসারের চিকিৎসা

চিকিৎসা নির্ভর করে ক্যানসারের ধরন, অবস্থান ও স্টেজের উপর।

১. সার্জারি

প্রাথমিক পর্যায়ে সাধারণত টিউমার ও আক্রান্ত লিম্ফ নোড সরিয়ে ফেলার জন্য অপারেশন করা হয়। প্রয়োজনে আশেপাশের টিস্যুও অপসারণ করা হয়।

২. রেডিয়েশন থেরাপি

এই পদ্ধতিতে দিনে ১–২ বার, সপ্তাহে ৫ দিন করে ২–৮ সপ্তাহ ধরে রেডিয়েশন দেওয়া হয়। পরবর্তী পর্যায়ে সাধারণত কেমোথেরাপির সঙ্গে মিলিয়ে এটি ব্যবহার করা হয়।

৩. কেমোথেরাপি

এই চিকিৎসায় এমন ওষুধ ব্যবহার করা হয় যা ক্যানসার কোষ ধ্বংস করে। ওষুধ মুখে বা ইনজেকশনের মাধ্যমে দেওয়া হয়। কিছু ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি হতে হতে পারে।

৪. টার্গেটেড থেরাপি

এই চিকিৎসায় ওষুধ সরাসরি ক্যানসার কোষের নির্দিষ্ট প্রোটিনে কাজ করে কোষের বৃদ্ধি বন্ধ করে দেয়।

৫. পুষ্টি

চিকিৎসার সময় খাওয়া ও গিলতে কষ্ট হতে পারে। তাই একজন পুষ্টিবিদের পরামর্শ নেওয়া উচিত যেন মুখ ও গলার জন্য উপযোগী খাবার নির্বাচন করা যায় এবং শরীর প্রয়োজনীয় ক্যালরি, ভিটামিন ও খনিজ পায়।

৬. মুখের যত্ন

চিকিৎসার সময় মুখের ভেতর পরিষ্কার ও আর্দ্র রাখা জরুরি। দাঁত ও মাড়ির পরিচর্যায় অবহেলা করা যাবে না।


চিকিৎসার পর সুস্থ হওয়া ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

সার্জারির পর

ছোট টিউমার অপসারণে সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা হয় না। বড় টিউমার অপসারণে চিবানো, গেলা ও কথা বলার সমস্যা হতে পারে। কখনো reconstructive surgery লাগতে পারে।

রেডিয়েশনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

  • গলা বা মুখে ব্যথা

  • মুখ শুকিয়ে যাওয়া

  • দাঁতের ক্ষয়

  • বমি, দুর্বলতা

  • মাড়ি ফাটে বা রক্ত পড়ে

  • মুখের সংক্রমণ

  • চোয়ালের ব্যথা

  • ক্লান্তি

  • স্বাদ ও গন্ধ পরিবর্তন

  • ত্বকে পোড়াভাব বা শুষ্কতা

  • ওজন কমে যাওয়া

  • থাইরয়েড সমস্যা

কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

  • চুল পড়া

  • মুখ ও মাড়িতে ব্যথা

  • মুখে রক্তপাত

  • অ্যানিমিয়া

  • দুর্বলতা

  • ক্ষুধামান্দ্য

  • বমি ও ডায়রিয়া

  • ঠোঁটে ও মুখে ঘা

  • হাত-পায়ে অবশভাব

টার্গেটেড থেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

  • জ্বর

  • মাথাব্যথা

  • বমি, ডায়রিয়া

  • অ্যালার্জি

  • ত্বকে র‍্যাশ


উপসংহার:
যদিও এই চিকিৎসাগুলোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে, তবে ক্যানসার থেকে মুক্তির জন্য এগুলো প্রয়োজনীয়। চিকিৎসক আপনাকে প্রতিটি বিকল্পের সুবিধা ও ঝুঁকি বুঝিয়ে সহায়তা করবেন।

মুখগহ্বর ক্যানসারের চিকিৎসার পর পুনর্গঠন ও পুনর্বাসন

যেসব রোগীর মুখগহ্বর ক্যানসার উন্নত পর্যায়ে নির্ণয় করা হয়, তাঁদের অনেকেরই পুনর্গঠনমূলক সার্জারি এবং কিছু পুনর্বাসন (rehabilitation) দরকার হয় যাতে তাঁরা স্বাভাবিকভাবে খাওয়া ও কথা বলার ক্ষমতা ফিরে পেতে পারেন।

পুনর্গঠন (Reconstruction)

পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় নিম্নলিখিত উপায়ে মুখ বা মুখমণ্ডলের হারানো হাড় ও টিস্যু প্রতিস্থাপন করা হয়:

  • ডেন্টাল ইমপ্লান্ট (Dental Implants)

  • গ্রাফট (Grafts) ব্যবহার করে হারানো হাড় বা টিস্যু প্রতিস্থাপন

  • কৃত্রিম তালু (Artificial Palate), যা মুখের ভেতরের হারানো অংশ বা দাঁতের জায়গা পূরণ করে

পুনর্বাসন (Rehabilitation)

উন্নত পর্যায়ের ক্যানসারে স্পিচ থেরাপি (speech therapy) প্রয়োজন হয়। এই থেরাপি সার্জারির পরপরই শুরু হতে পারে এবং যতক্ষণ না আপনি আপনার সর্বোচ্চ উন্নয়নের স্তরে পৌঁছান, ততদিন চলতে পারে।


ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা (Outlook)

মুখগহ্বর ক্যানসারের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে:

  • ক্যানসারের নির্দিষ্ট ধরন ও পর্যায় (type and stage)

  • আপনার সাধারণ স্বাস্থ্য, বয়স

  • চিকিৎসা সহ্য করার ক্ষমতাপ্রতিক্রিয়া (response to treatment)

প্রারম্ভিক পর্যায়ে শনাক্তকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ স্টেজ ১ ও ২ পর্যায়ের ক্যানসার তুলনামূলকভাবে কম জটিল চিকিৎসায় সেরে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।


চিকিৎসার পর নিয়মিত পরীক্ষা

চিকিৎসার পরে, নিশ্চিত করতে হবে যে আপনি সুস্থভাবে সেরে উঠছেন। এজন্য চিকিৎসক আপনাকে নিয়মিত ফলো-আপে যেতে বলবেন। এই ফলো-আপগুলো সাধারণত অন্তর্ভুক্ত করবে:

  • শারীরিক পরীক্ষা

  • রক্ত পরীক্ষা

  • এক্স-রে

  • সিটি স্ক্যান (CT scan)

আপনার মুখে, গলায় বা শরীরে অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ্য করলে, অবিলম্বে ডেন্টিস্ট বা ক্যানসার বিশেষজ্ঞের (oncologist) সঙ্গে যোগাযোগ করুন।

মুখগহ্বরের ক্যানসার
মুখগহ্বরের ক্যানসার

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top