পেটের ক্যান্সার

পেটের ক্যান্সার কী?

পেটের ক্যান্সার ঘটে যখন পেটের ভেতরের আস্তরণে ক্যান্সারজনিত কোষ বৃদ্ধি পায়। এই ধরনের ক্যান্সারকে গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সারও বলা হয়। এটি নির্ণয় করা কঠিন হতে পারে কারণ প্রাথমিক পর্যায়ে বেশিরভাগ মানুষের কোনো লক্ষণ দেখা দেয় না। ফলস্বরূপ, এটি প্রায়ই শরীরের অন্য অংশে ছড়িয়ে পড়ার পরেই ধরা পড়ে।

ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউট (NCI) অনুযায়ী, ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ২৭,০০০ নতুন পেটের ক্যান্সারের ঘটনা ঘটেছে। NCI এর অনুমান অনুযায়ী, পেটের ক্যান্সার যুক্তরাষ্ট্রে নতুন ক্যান্সার কেসের ১.৪ শতাংশ ছিল।

যদিও পেটের ক্যান্সার নির্ণয় ও চিকিৎসা করা কঠিন, তবুও এই রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য যথাযথ জ্ঞান অর্জন করা গুরুত্বপূর্ণ।

পেটের ক্যান্সারের কারণ কী?

আপনার পেট (যা খাদ্যনালী বা এইসোফেগাসের সাথে যুক্ত) হলো আপনার পাচনতন্ত্রের উপরের অংশের একটি অংশ। পেটের কাজ হলো খাবার হজম করা এবং পরবর্তী পাচন অঙ্গগুলো — যেমন ছোট ও বড় অন্ত্র — এ পুষ্টি পৌঁছে দেওয়া।

পেটের ক্যান্সার তখন হয় যখন স্বাভাবিক ও স্বাস্থ্যকর কোষগুলো উপরের পাচনতন্ত্রে ক্যান্সার কোষে পরিণত হয়ে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বৃদ্ধি পায় এবং একটি টিউমার তৈরি করে। এই প্রক্রিয়াটি সাধারণত ধীরে ধীরে ঘটে এবং বেশ কয়েক বছর ধরে বিকাশ লাভ করে।


পেটের ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধিকারক কারণসমূহ:

নিম্নলিখিত কিছু রোগ এবং অবস্থা আপনার পেটে ক্যান্সার কোষের সম্ভাবনা বাড়াতে পারে:

  • হেলিকোব্যাকটার পাইলোরি (H. pylori) ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ: একটি সাধারণ পেটের সংক্রমণ যা মাঝে মাঝে আলসার তৈরি করতে পারে।

  • পাচনতন্ত্রের অন্যান্য অংশে টিউমার থাকা

  • পেটের পলিপস: পেটের আস্তরণে অস্বাভাবিক টিস্যুর বৃদ্ধি

  • বংশগত জেনেটিক সিনড্রোম, যেমন লিঞ্চ সিনড্রোম এবং লাই-ফ্রাউমেনি সিনড্রোম


পেটের ক্যান্সার সাধারণত বেশি দেখা যায়:

  • ৬০ বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তিদের মধ্যে

  • পুরুষদের মধ্যে

  • যারা ধূমপান করেন

  • যারা অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা যুক্ত

  • যাদের পরিবারের কারো এই রোগের ইতিহাস আছে

  • যারা এশীয় (বিশেষ করে কোরিয়ান বা জাপানি), দক্ষিণ আমেরিকান বা পূর্ব ইউরোপীয় বংশোদ্ভুত


ব্যক্তিগত চিকিৎসা ইতিহাস ছাড়াও, কিছু জীবনধারা বিষয়ক কারণ ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে:

  • অনেক লবণযুক্ত বা প্রক্রিয়াজাত খাবার খাওয়া

  • নিয়মিত মাংস খাওয়া

  • ফল খুব কম বা একেবারেই না খাওয়া

  • অনেক মদ্যপান (প্রতি দিনে অন্তত তিন বার বা তার বেশি)

  • পর্যাপ্ত ব্যায়াম না করা

  • ধূমপান করা

  • খাবার সঠিকভাবে সংরক্ষণ বা রান্না না করা


স্ক্রিনিং টেস্টের কথা ভাবা উচিত যদি আপনি মনে করেন আপনি পেটের ক্যান্সারের ঝুঁকিতে আছেন।
স্ক্রিনিং টেস্ট তখন করা হয় যখন কেউ কোনো রোগের ঝুঁকিতে থাকে কিন্তু এখনও তার কোনো উপসর্গ দেখা দেয়নি।

পেটের ক্যান্সারের উপসর্গ

আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি (American Cancer Society) অনুযায়ী, পেটের ক্যান্সারের প্রাথমিক পর্যায়ে সাধারণত কোনো লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা যায় না। এর মানে হলো, অনেক সময় রোগী বুঝতে পারেন না যে কিছু ভুল হয়েছে যতক্ষণ না ক্যান্সার উন্নত পর্যায়ে চলে যায়।

তবে কিছু ক্ষেত্রে রোগের উপসর্গ দেখা দিতে পারে। পেটের ক্যান্সারের সবচেয়ে সাধারণ উপসর্গগুলো হলো:

  • ঘন ঘন হার্টবার্ন (জ্বালা)

  • ক্ষুধার কমে যাওয়া

  • নিয়মিত পেট ফোলা

  • হজমের সমস্যা এবং ঘন ঘন ডকার দেওয়া

  • অল্প খাবার খাওয়ার পর তাড়াতাড়ি পূর্ণতা অনুভব করা (early satiety)

  • অতিরিক্ত ক্লান্তি

  • স্থায়ী পেটের ব্যথা

এই উপসর্গগুলো অনেক সময় আলসার বা সংক্রমণসহ অন্যান্য অবস্থাতেও দেখা যায়, যা পেটের ক্যান্সার নির্ণয় কঠিন করে তোলে। যদি আপনার এই ধরনের উপসর্গ থাকে এবং তা ভালো না হয়, তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।


ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়লে যাকে মেটাস্টাসিস বলা হয়, তখন আগ্রাসী বা মেটাস্ট্যাটিক পেটের ক্যান্সারের উপসর্গ হতে পারে:

  • রক্তমিশ্রিত পায়খানা

  • বমি বমি ভাব এবং বমি

  • পেটের উপরের অংশে একটি গাঁট বা ফোলা

  • পিলকি হলুদ রং (জন্ডিস) – ক্যান্সার যদি লিভারে ছড়ায়

  • অজানা কারণে ওজন কমে যাওয়া


পেটের ক্যান্সারের উপসর্গ নারী ও পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই সাধারণত একই রকম, তবে এটি পুরুষদের মধ্যে বেশি সাধারণ। শিশুদের মধ্যে উপসর্গ হিসেবে কখনো কখনো কোষ্ঠকাঠিন্য বা ডায়রিয়া দেখা যেতে পারে, তবে অন্যথায় তারা বয়স্কদের মতোই উপসর্গ প্রকাশ করে।

কিভাবে পেটের ক্যান্সার নির্ণয় করা হয়?

পেটের ক্যান্সার সাধারণত প্রাথমিক পর্যায়ে উপসর্গ কম থাকায় অনেক সময় রোগটি উন্নত পর্যায়ে এসে ডায়াগনোসিস করা হয়।

পেটের ক্যান্সার নির্ণয়ের জন্য প্রথমেই একটি শারীরিক পরীক্ষা (physical exam) করা হয়, যাতে শরীরের কোনো অস্বাভাবিকতা চিহ্নিত করা যায়। ডাক্তার পায়খানায় রক্তের উপস্থিতি খুঁজে বের করতে পরীক্ষা করতে পারেন, এবং রক্ত পরীক্ষা করে অ্যানিমিয়া আছে কিনা দেখা হয়।

যদি ডাক্তার মনে করেন যে রোগীর মধ্যে ক্যান্সারের সম্ভাবনা রয়েছে, তবে আরও কিছু নির্ণায়ক পরীক্ষা করানো হয়। এই পরীক্ষাগুলো বিশেষভাবে পেট এবং খাদ্যনালীর টিউমার বা অন্য কোনো অস্বাভাবিকতা শনাক্ত করতে সাহায্য করে। এসব পরীক্ষার মধ্যে থাকতে পারে:

  • উপরের গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল (GI) এন্ডোস্কোপি (উচ্চ পেটে ছোট ক্যামেরা প্রবেশ করিয়ে দেখা)

  • বায়োপসি (টিউমার থেকে টিস্যুর নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা)

  • ইমেজিং পরীক্ষা, যেমন CT স্ক্যান এবং এক্স-রে


পেটের ক্যান্সারের স্টেজ (পর্যায়)

ক্যান্সারের স্টেজ নির্দেশ করে ক্যান্সার শরীরের কতটা অংশে ছড়িয়েছে।

সাধারণত আমেরিকান জয়েন্ট কমিটি অন ক্যান্সার (AJCC) এর TNM সিস্টেম ব্যবহার করে স্টেজ নির্ধারণ করা হয়। এই সিস্টেম তিনটি বিষয় বিবেচনা করে:

  • T (Tumor): টিউমারের আকার এবং কতদূর ছড়িয়েছে

  • N (Nodes): লিম্ফ নোডে ক্যান্সার কতদূর ছড়িয়েছে

  • M (Metastasis): শরীরের দূরের কোনো অংশে ক্যান্সার ছড়িয়েছে কিনা

এই তথ্যগুলো মিলিয়ে স্টেজ ০ থেকে ৪ পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়, যেখানে ছোট নম্বর মানে প্রাথমিক স্টেজ এবং বড় নম্বর মানে উন্নত স্টেজ।

স্টেজের সাধারণ বিবরণ:

  • স্টেজ ০: ক্যান্সার শুধু পেটের স্তরের একদম বাইরের অংশে, লিম্ফ নোড বা অন্য অংশে ছড়ায়নি।

  • স্টেজ ১: টিউমার পেটের গভীরে পৌঁছেছে, লিম্ফ নোডে কিছুটা ছড়াতে পারে কিন্তু শরীরের অন্য অংশে ছড়ায়নি।

  • স্টেজ ২: টিউমার পেটের গভীর স্তরে পৌঁছেছে, লিম্ফ নোডে সাধারণত ছড়িয়েছে, কিন্তু শরীরের অন্য অংশে ছড়ায়নি।

  • স্টেজ ৩: টিউমার আরও গভীরে এবং কাছের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ছড়িয়েছে, লিম্ফ নোডে বেশি ছড়িয়েছে কিন্তু দূরবর্তী অংশে নয়।

  • স্টেজ ৪: ক্যান্সার পেটের গভীর স্তরে বা লিম্ফ নোডে থাকতে পারে, তবে দূরবর্তী অঙ্গ যেমন ফুসফুস, মস্তিষ্ক বা লিভারে ছড়িয়ে গেছে।


পেটের ক্যান্সারের চিকিৎসা

পেটের ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য নিচের পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করা হয়:

  • কেমোথেরাপি (Chemotherapy)

  • রেডিয়েশন থেরাপি (Radiation therapy)

  • সার্জারি (Surgery)

  • ইমিউনোথেরাপি (Immunotherapy), যা আপনার ইমিউন সিস্টেমকে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে কার্যকর করে তোলে

চিকিৎসার সঠিক পরিকল্পনা নির্ভর করবে ক্যান্সারের ধরন, স্টেজ, রোগীর বয়স এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্যগত অবস্থার ওপর।

চিকিৎসার মূল লক্ষ্য ক্যান্সার কোষ ছড়ানো বন্ধ করা। untreated পেটের ক্যান্সার সাধারণত নিচের অঙ্গগুলোতে ছড়াতে পারে:

  • ফুসফুস

  • লিম্ফ নোড

  • হাড়

  • লিভার


পেটের ক্যান্সার প্রতিরোধ

পেটের ক্যান্সার সম্পূর্ণরূপে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়, তবে ঝুঁকি কমানো যায় নিচের উপায়ে:

  • ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা

  • সুষম খাদ্য গ্রহণ

  • অ্যালকোহল সেবন সীমিত করা

  • ধূমপান থেকে বিরত থাকা

  • নিয়মিত ব্যায়াম করা

কিছু ক্ষেত্রে ডাক্তাররা ঔষধও দিতে পারেন, বিশেষ করে যাদের প্রিক্যান্সার অথবা নির্দিষ্ট ঝুঁকি রয়েছে।


স্ক্রীনিং টেস্ট

ঝুঁকিতে থাকলে প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার ধরা পড়ার জন্য কিছু স্ক্রীনিং পরীক্ষা করানো যেতে পারে, যেমন:

  • শারীরিক পরীক্ষা

  • রক্ত ও প্রস্রাব পরীক্ষা

  • এক্স-রে ইমেজিং

  • এন্ডোস্কোপি (থ্রোটের মাধ্যমে ক্যামেরা প্রবেশ)

  • জেনেটিক পরীক্ষা

এই পরীক্ষাগুলো সময়মতো ক্যান্সার শনাক্ত করতে সাহায্য করে এবং দ্রুত চিকিৎসার সুযোগ দেয়।

দীর্ঘমেয়াদী সম্ভাবনা (Long-term Outlook)

পেটের ক্যান্সারের প্রাথমিক পর্যায়ে ডায়াগনোসিস হলে সুস্থ হওয়ার সুযোগ অনেক বেশি থাকে। ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউট (NCI) অনুসারে, প্রায় ৩২ শতাংশ রোগীর পেটের ক্যান্সার ধরা পড়ার পাঁচ বছর পরও বেঁচে থাকার সম্ভাবনা থাকে।

এই বেঁচে থাকা রোগীদের বেশিরভাগই লোকালাইজড ক্যান্সার অর্থাৎ ক্যান্সার পেটেই সীমাবদ্ধ থাকে এবং শরীরের অন্য অংশে ছড়ায় না। যখন ক্যান্সারের মূল উৎস অজানা থাকে, তখন ডায়াগনোসিস এবং স্টেজ নির্ধারণ কঠিন হয়, যা চিকিৎসাকে আরও জটিল করে তোলে।

পেটের ক্যান্সার যখন পরবর্তী বা উন্নত পর্যায়ে পৌঁছায়, তখন চিকিৎসা করা আরও কঠিন হয়ে পড়ে। যদি আপনার ক্যান্সার উন্নত পর্যায়ে থাকে, তাহলে আপনি ক্লিনিকাল ট্রায়ালে অংশ নেওয়ার কথা ভাবতে পারেন।

ক্লিনিকাল ট্রায়াল কী?
ক্লিনিকাল ট্রায়াল হলো নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি, ডিভাইস বা ওষুধ ক্যান্সার বা অন্যান্য রোগের জন্য কতটা কার্যকর তা পরীক্ষা করার একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা।

আপনি NCI ওয়েবসাইটে গিয়ে পেটের ক্যান্সারের জন্য চলমান ক্লিনিকাল ট্রায়ালের তথ্য জানতে পারেন।

ওয়েবসাইটে পেটের ক্যান্সার নির্ণয় এবং চিকিৎসার পরবর্তী সময়ে আপনাকে এবং আপনার পরিবারের সদস্যদের সহায়তার জন্য বিভিন্ন রিসোর্সও পাওয়া যাবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top