“এসোফেজিয়াল ক্যান্সার বা খাদ্যনালির ক্যান্সার সম্পর্কে সব কিছু জানতে”

এসোফেজিয়াল ক্যান্সারের প্রাথমিক পর্যায়ে আপনি কোনো লক্ষণ অনুভব নাও করতে পারেন। তবে, ক্যান্সার বাড়ার সাথে সাথে আপনি বমি, খাবার খেতে গিয়ে বারবার গলাধঃকরণ হওয়া, অথবা দীর্ঘস্থায়ী কাশি এর মতো লক্ষণ অনুভব করতে পারেন।

এসোফেগাস হলো একটি খালি পেশীবহুল নালী, যা গল থেকে খাবারকে পেটে নিয়ে যায়। এসোফেজিয়াল ক্যান্সার তখন ঘটে যখন এসোফেগাসের অভ্যন্তরীণ পর্দায় একটি দুষ্টু টিউমার গঠন হয়।

যখন টিউমার বাড়তে থাকে, তখন এটি এসোফেগাসের গভীর টিস্যু এবং পেশীতে প্রভাব ফেলতে পারে। টিউমার এসোফেগাসের যেকোনো অংশে দেখা দিতে পারে, এমনকি যেখানে এসোফেগাস এবং পেট মিলিত হয় সেই জায়গায়ও।

ইসোফেজিয়াল ক্যান্সারের উপসর্গ ও প্রাথমিক লক্ষণ কী কী?
ইসোফেজিয়াল ক্যান্সারের প্রাথমিক ধাপে সাধারণত কোনো লক্ষণ দেখা যায় না।

তবে ক্যান্সার বাড়ার সাথে সাথে নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে:

  • গিলতে সমস্যা হওয়া বা গিলার সময় ব্যথা অনুভব করা

  • বুকে ব্যথা

  • অপ্রত্যাশিত ওজন হ্রাস

  • দীর্ঘস্থায়ী কাশি

  • কণ্ঠস্বর ভেঙে যাওয়া বা কর্কশ হয়ে যাওয়া

  • বমি হওয়া

  • ইসোফেগাসে রক্তপাত হওয়া, যার কারণে মল কালো হয়ে যেতে পারে

  • রক্তাল্পতার (অ্যানিমিয়া) কারণে ক্লান্তি

  • ক্যান্সার শরীরের অন্য অংশে ছড়িয়ে পড়লে হাড়ে ব্যথা ও অন্যান্য উপসর্গ

  • হজমে সমস্যা ও হার্টবার্ন (গ্যাস্ট্রিকের মতো জ্বালা)

  • ত্বকের নিচে চাকা বা গাঁট দেখা যাওয়া


ইসোফেজিয়াল ক্যান্সারের কারণ কী?
ইসোফেজিয়াল ক্যান্সারের নির্দিষ্ট কারণ এখনো পুরোপুরি জানা যায়নি। তবে এটি ইসোফেগাস-সংক্রান্ত কোষের ডিএনএ-তে পরিবর্তনের (মিউটেশন) মাধ্যমে ঘটে।

এই পরিবর্তনের ফলে কোষগুলো স্বাভাবিকের চেয়ে দ্রুত বিভাজিত হয় এবং স্বাভাবিকভাবে মরার সংকেত পায় না। ফলে কোষগুলো জমে টিউমারে পরিণত হয়।


ইসোফেজিয়াল ক্যান্সারের কতগুলো ধরন আছে?
হ্যাঁ, ইসোফেজিয়াল ক্যান্সারের প্রধানত দুটি ধরন রয়েছে:

  1. স্কোয়ামাস সেল কার্সিনোমা (Squamous Cell Carcinoma):
    এই ধরনের ক্যান্সার সাধারণত ইসোফেগাসের ওপরের ও মাঝখানের অংশে দেখা যায় এবং এটি পৃষ্ঠতলের স্কোয়ামাস কোষগুলো থেকে শুরু হয়।

  2. অ্যাডেনোকার্সিনোমা (Adenocarcinoma):
    এই ধরনের ক্যান্সার ইসোফেগাসের নিচের অংশে বেশি দেখা যায়, বিশেষ করে যেখানে ইসোফেগাস এবং পাকস্থলি মিলিত হয়। এটি সাধারণত গ্ল্যান্ড কোষ থেকে শুরু হয়।

প্রতিটি ধরন আলাদা আচরণ করে এবং চিকিৎসা পদ্ধতিও ভিন্ন হতে পারে।

ইসোফেজিয়াল ক্যান্সারের ঝুঁকির কারণসমূহ কী কী?
নিম্নলিখিত কিছু কারণ ইসোফেজিয়াল ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়াতে পারে:

  • অ্যালকোহল সেবন: নিয়মিত ও অতিরিক্ত অ্যালকোহল পান ইসোফেজিয়াল ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

  • ধূমপান: দীর্ঘদিন ধূমপান করা ইসোফেগাসের কোষে ক্ষতি করে এবং ক্যান্সারের সম্ভাবনা বাড়ায়।

  • রিফ্লাক্স জনিত রোগ (যেমন GERD): গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজে (GERD) পাকস্থলীর অ্যাসিড বারবার ইসোফেগাসে উঠে আসে, যা কোষের ক্ষতি করে।

  • ব্যারেট’স ইসোফেগাস (Barrett’s Esophagus): GERD-এর কারণে ইসোফেগাসের অভ্যন্তরীণ আস্তরণ ক্ষতিগ্রস্ত হলে ব্যারেট’স ইসোফেগাস হয়, যা ক্যান্সারের পূর্বলক্ষণ হিসেবে বিবেচিত।

  • স্থূলতা ও GERD-এর সংমিশ্রণ: অতিরিক্ত ওজন এবং GERD থাকলে ক্যান্সারের ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়।

  • পুরুষ হওয়া: পুরুষদের ইসোফেজিয়াল ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি নারীদের তুলনায় প্রায় তিন গুণ বেশি।

এই ঝুঁকিগুলোর মধ্যে একাধিক থাকলে, ইসোফেজিয়াল ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি হয়।

ইসোফেজিয়াল ক্যান্সার নির্ণয় (Diagnosing Esophageal Cancer)

ইসোফেজিয়াল ক্যান্সার শনাক্ত করার জন্য চিকিৎসকরা নিচের পরীক্ষাগুলো করে থাকেন:

  • এন্ডোস্কোপি: একটি ক্যামেরা যুক্ত নল গলার ভিতর দিয়ে ইসোফেগাসে প্রবেশ করানো হয়। এটি ইসোফেগাসের আস্তরণ পরিদর্শনে সহায়তা করে, যাতে কোনো অস্বাভাবিকতা বা প্রদাহ আছে কি না তা বোঝা যায়।

  • ব্যারিয়াম স্যোয়ালো (Barium Swallow): এটি এক ধরনের এক্স-রে পরীক্ষা, যেখানে রোগী ব্যারিয়াম নামক রাসায়নিক গিলে ফেলেন এবং তার মাধ্যমে ইসোফেগাসের গঠন দেখা যায়।

  • বায়োপসি (Biopsy): এন্ডোস্কোপের সাহায্যে সন্দেহজনক টিস্যুর নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়।

  • CT স্ক্যান, PET স্ক্যান বা MRI: এই চিত্রায়ণ পদ্ধতিগুলো ক্যান্সার শরীরের অন্য অংশে ছড়িয়েছে কি না তা নির্ধারণ করতে ব্যবহৃত হয়।

প্রায় অর্ধেক রোগীর ক্ষেত্রেই ক্যান্সার ধরা পড়ে যখন এটি ইতোমধ্যে ইসোফেগাসের বাইরে ছড়িয়ে পড়ে।


ইসোফেজিয়াল ক্যান্সারের চিকিৎসা (Treating Esophageal Cancer)

চিকিৎসা নির্ভর করে ক্যান্সারের পর্যায় ও অন্যান্য উপসর্গের ওপর। সাধারণ চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো হলো:

🟢 অস্ত্রোপচার (Surgery):

  • ছোট আকারের ক্যান্সার হলে এন্ডোস্কোপ এবং ছোট ছোট কাটার মাধ্যমে টিউমার অপসারণ করা যায়।

  • বড় টিউমার হলে ইসোফেগাসের একটি অংশ ও প্রয়োজনে লিম্ফ নোড অপসারণ করে পেট বা বৃহৎ অন্ত্রের টিস্যু দিয়ে পুনরায় তৈরি করা হয়।

  • কখনো কখনো পাকস্থলীর উপরের অংশও কেটে ফেলতে হয়।

🟠 কেমোথেরাপি (Chemotherapy):

  • ওষুধের মাধ্যমে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করা হয়।

  • অস্ত্রোপচারের আগে বা পরে এটি ব্যবহার করা হতে পারে।

  • কখনো কখনো এটি রেডিয়েশন থেরাপির সাথে একত্রে প্রয়োগ করা হয়।

🔵 রেডিয়েশন থেরাপি (Radiation Therapy):

  • রেডিয়েশনের মাধ্যমে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করা হয়।

  • দুটি উপায়ে এটি দেওয়া যায়: বাইরের যন্ত্র দিয়ে বা টিউমারের কাছাকাছি একটি যন্ত্র বসিয়ে (ব্র্যাকিথেরাপি)।

🟣 অন্যান্য চিকিৎসা:

  • স্টেন্ট বসানো: টিউমার ইসোফেগাস বন্ধ করে দিলে, খাবার চলাচল স্বাভাবিক রাখতে স্টেন্ট বসানো হয়।

  • লেজার থেরাপি: আলো-সক্রিয় ওষুধ দিয়ে টিউমার আক্রান্ত কোষ ধ্বংস করা হয়।


ইসোফেজিয়াল ক্যান্সারের ধাপসমূহ (Stages of Esophageal Cancer)

স্তর বিবরণ
Stage 0 ক্যান্সার কেবলমাত্র উপরের স্তরের কোষে সীমাবদ্ধ (হাই-গ্রেড ডিসপ্লাসিয়া)।
Stage 1 ক্যান্সার ইসোফেগাসে আছে কিন্তু লিম্ফ নোডে ছড়ায়নি।
Stage 2 ক্যান্সার গভীর টিস্যুতে পৌঁছেছে এবং লিম্ফ নোডে থাকতে পারে।
Stage 3 ক্যান্সার লিম্ফ নোড এবং আশেপাশের টিস্যুতে পৌঁছেছে কিন্তু শরীরের দূরবর্তী অঙ্গে ছড়ায়নি।
Stage 4 ক্যান্সার শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়েছে, যেমন যকৃত বা ফুসফুসে।

জীবন প্রত্যাশা ও ভবিষ্যদ্বাণী (Life Expectancy and Outlook)

আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটির মতে, ৫ বছরের আপেক্ষিক বেঁচে থাকার হার হলো:

ক্যান্সারের স্তর ৫ বছরের বেঁচে থাকার হার
স্থানীয় (Localized) ৪৭%
আঞ্চলিক (Regional) ৩৩%
দূরবর্তী (Distant) ৬%
সামগ্রিক (Overall) ২১%

এই হারগুলো গড় পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তির নির্দিষ্ট অবস্থার ওপর ভিত্তি করে নয়। বয়স, স্বাস্থ্যের অবস্থা ইত্যাদিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।


শেষ ধাপের ইসোফেজিয়াল ক্যান্সার চিনে নেওয়া (Recognizing End-stage Esophageal Cancer)

শেষ ধাপের ক্যান্সারে সাধারণত দেখা যায়:

  • তীব্র দুর্বলতা এবং ক্লান্তি

  • খাবার গিলতে সম্পূর্ণ অক্ষমতা

  • প্রবল ও নিয়মিত বমি

  • ওজন দ্রুত কমে যাওয়া

  • যন্ত্রণা বা অস্বস্তি

  • রক্তস্বল্পতা ও রক্তক্ষরণ

  • শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা

  • মানসিক বিভ্রান্তি (যদি ক্যান্সার মস্তিষ্কে ছড়ায়)

    ইসোফেজিয়াল ক্যান্সার প্রতিরোধ (Preventing Esophageal Cancer)

    ইসোফেজিয়াল ক্যান্সার পুরোপুরি প্রতিরোধের নিশ্চিত উপায় নেই, তবে কিছু পদক্ষেপ ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে:

    • ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য থেকে বিরত থাকুন

    • অ্যালকোহল সেবন সীমিত করুন

    • গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ (GERD) থাকলে চিকিৎসা গ্রহণ করুন

    • চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কিছু ওষুধ (যেমন: NSAIDs) গ্রহণ করতে পারেন যা ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে

    • স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন অনুসরণ করুন — ব্যালান্সড ডায়েট এবং নিয়মিত ব্যায়াম করুন


    প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (Frequently Asked Questions)

    🔵 ইসোফেজিয়াল ক্যান্সারের ক্ষেত্রে জীবন প্রত্যাশা কত?

    এটি নির্ভর করে রোগ নির্ণয়ের সময় ক্যান্সারের ধাপ, রোগীর বয়স, এবং চিকিৎসার প্রতিক্রিয়ার ওপর। গড় হিসেবে, ইসোফেজিয়াল ক্যান্সারে আক্রান্ত ব্যক্তি অন্যদের তুলনায় প্রায় ২১% ক্ষেত্রে আরও অন্তত ৫ বছর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা রাখেন।


    🔵 ইসোফেজিয়াল ক্যান্সারের উপসর্গ কী কী?

    শুরুর দিকে সাধারণত কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। তবে ক্যান্সার বেড়ে উঠলে লক্ষণ দেখা দিতে পারে:

    • গিলতে সমস্যা

    • দীর্ঘস্থায়ী কাশি

    • গলা ভেঙে যাওয়া বা কর্কশ কণ্ঠস্বর

    • বুকজ্বালা বা হজমের সমস্যা (ইনডাইজেশন ও হার্টবার্ন)

    • ত্বকের নিচে চাকা বা গাঁট

    • অপ্রত্যাশিত ওজন কমে যাওয়া


    🔵 ইসোফেজিয়াল ক্যান্সার কি সম্পূর্ণ সারানো যায়?

    এই ক্যান্সার সাধারণত সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য নয়। তবে চিকিৎসার মাধ্যমে জীবনকাল বাড়ানো এবং জীবনমান উন্নত করা সম্ভব।
    যদি ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়ে এবং ছড়ায় না, তবে রোগীর ৪৭% ক্ষেত্রে আরও অন্তত ৫ বছর বা তার বেশি সময় বেঁচে থাকার সম্ভাবনা থাকে।

    সারাংশ (Summary in Bangla):

    ইসোফেজিয়াল ক্যান্সার হলো এমন একটি ক্যান্সার যা গলায় খাবার নেওয়ার নল (ইসোফাগাস) কে প্রভাবিত করে, যা খাদ্যকে গলা থেকে পেটে নিয়ে যায়। প্রাথমিক পর্যায়ে সাধারণত কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। তবে সময়ের সাথে সাথে কাশি, গলা বসে যাওয়া, বুকজ্বালা (হার্টবার্ন) এবং অন্যান্য উপসর্গ দেখা দিতে পারে।

    এই ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণে চিকিৎসা পাওয়া যায়। চিকিৎসার ধরন নির্ভর করে ক্যান্সারের ধাপ ও অন্যান্য বিষয়ের ওপর। সাধারণত ব্যবহৃত চিকিৎসাগুলোর মধ্যে রয়েছে:

    • সার্জারি

    • রেডিয়েশন থেরাপি

    • কেমোথেরাপি

এসোফেজিয়াল ক্যান্সার

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top